Translate

Tuesday, October 21, 2025

সখারাম গণেশ পণ্ডিত: এক ভারতীয় যিনি আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ইতিহাস লিখেছিলেন





ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যখন আমাদের দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন এক ভারতীয় যুবক হাজার মাইল দূরে আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব চালাচ্ছিলেন। তাঁর নাম সখারাম গণেশ পণ্ডিত (Sakharam Ganesh Pandit) — যিনি শুধু একজন আইনজীবী নন, ছিলেন মানবাধিকারের এক অগ্রদূত। তাঁর জীবনের কাহিনি সাহস, অধ্যবসায় ও ন্যায়বোধের এক অসাধারণ উদাহরণ।



🎓 প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

সখারাম গণেশ পণ্ডিত ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও ন্যায়পরায়ণ। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান — সেই সময় খুব কম ভারতীয়ই বিদেশে যেতেন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে।
তিনি সেখানে আইন (Law) পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় আইনজীবী হিসেবে নিজের পেশা শুরু করেন।



⚖️ কর্মজীবন ও সংগ্রাম

আমেরিকায় তখনকার সমাজে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। এশীয় ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষদের অনেক মৌলিক অধিকার ছিল না — তারা নাগরিকত্ব, জমির মালিকানা বা অনেক সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল।

সখারাম গণেশ পণ্ডিত এই অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, সমস্ত ভারতীয় অভিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনি লড়াই শুরু করেন।

১৯১৪ সালে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে কারণ তখন তাঁকে “white” জাতির অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছিল। ফলে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে একজন হন।

কিন্তু ১৯২৩ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের Bhagat Singh Thind মামলায় ঘোষণা করা হয় যে ভারতীয়রা ‘white’ নয়, তাই তারা নাগরিক হতে পারবে না। ফলস্বরূপ, সরকার সখারাম পণ্ডিতের নাগরিকত্বও বাতিল করে দেয়।

কিন্তু তিনি হার মানেননি। নিজের আইনি জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসে ভর করে তিনি লড়াই চালিয়ে যান — এবং তাঁর নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
তিনি একমাত্র ভারতীয় যিনি তখন নিজের নাগরিকত্ব ফেরত পান — যা ছিল আমেরিকার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।



💍 ব্যক্তিগত জীবন

সখারাম পণ্ডিতের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্ত।
তিনি Lina Pandit নামে এক ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত মহিলাকে বিয়ে করেন। সেই সময়ে আন্তঃজাত বা আন্তঃবর্ণ বিবাহ আমেরিকার বহু অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ ছিল।
তবু তাঁরা সমাজের নিয়ম ভেঙে ভালোবাসা ও মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। Lina নিজেও পণ্ডিতের মতো মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁর কাজে পাশে থেকেছেন সবসময়।



🕊️ সামাজিক ও মানবাধিকারমূলক অবদান

সখারাম গণেশ পণ্ডিত শুধু একজন আইনজীবী ছিলেন না — তিনি ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক ও মানবাধিকার কর্মী।
তিনি আমেরিকায় ভারতীয় অভিবাসীদের সংগঠিত করতে সাহায্য করেন এবং তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য বক্তৃতা, লেখালিখি ও আইনি পরামর্শ দিতেন।
তিনি বর্ণবৈষম্য, নারীর অধিকার ও শিক্ষার সমান সুযোগের বিষয়ে সরব ছিলেন।
তাঁর বক্তৃতা ও চিন্তাভাবনা আমেরিকার সামাজিক সচেতনতার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।



📜 ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উত্তরাধিকার

সখারাম গণেশ পণ্ডিতের জীবন এক অধিকার ও সম্মানের সংগ্রাম।
তাঁর নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধারের ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত জয় নয়, বরং ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় — যা দেখিয়েছিল, আইন ও মানবতার শক্তি কত বড় হতে পারে।

আজকের দিনে যখন নাগরিক অধিকার ও জাতিগত সমতার প্রশ্ন উঠে আসে, তখন পণ্ডিতের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের ভারতীয়-আমেরিকান যিনি সমাজে নিজের স্থান তৈরি করেছিলেন সাহস ও জ্ঞানের মাধ্যমে।




সখারাম গণেশ পণ্ডিতের জীবন কেবল একজন ব্যক্তির সাফল্যের গল্প নয় — এটি হলো ন্যায়, মানবতা ও আত্মসম্মানের বিজয়গাথা।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস থাকলে, একজন মানুষও ইতিহাস বদলে দিতে পারে।
আজও তাঁর সংগ্রাম ও আদর্শ ভারতীয় অভিবাসী সমাজ ও মানবাধিকারের ইতিহাসে এক অমলিন দৃষ্টান্ত।

Saturday, October 18, 2025

আলো, শক্তি ও মা কালী: ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি

 



 

কালীপুজোর রাতে বাংলার ঘর, উঠোন, বারান্দা, পথঘাট থেকে শ্মশান পর্যন্ত প্রদীপের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। অনেকেই এটাকে শুধু উৎসবের সাজ বা অমাবস্যার আলো বলে মনে করেন, কিন্তু এই প্রদীপজ্বালানোর রীতির জড় roots রয়েছে প্রাচীন শাক্তধর্ম, গ্রামীণ লোকবিশ্বাস, পূর্বপুরুষ আর তন্ত্রসাধনার সঙ্গে। এই আলো কেবল অন্ধকার ভাঙে না, বরং দেবীর আহ্বান, অশুভশক্তি নিবারণ, জীবনীশক্তি রক্ষা এবং শক্তির অভিষেকের প্রতীক।

 

উৎস: অন্ধকার থেকে শক্তির আহ্বান

কালীপুজো হয় কার্তিক অমাবস্যায়—যে রাতে আকাশে একফোঁটা চাঁদের আলোও থাকে না। প্রাচীন শাস্ত্রে বলা আছে, “অন্ধকারই শক্তির অগ্নিপথ”, তাই সেই রাতে আলো জ্বালিয়ে শক্তির আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রচলন গড়ে ওঠে। গ্রামবাংলায় বিশ্বাস ছিল, কার্তিকের অমাবস্যায় অশরীরী শক্তি, ভূতপ্রেত আর দুর্ভাগ্যের ছায়া নেমে আসে। তাই বাড়ির চার কোণে, দরজার সামনে, তুলসীতলার পাশে কাঁচা প্রদীপ জ্বালিয়ে অশুভ শক্তিকে দূরে রাখা হত।

 

তন্ত্র ও প্রদীপ: শক্তির আসন প্রস্তুতি

তান্ত্রিক পূজায় আগুনকে ধরা হয় জীবন্ত মাধ্যম—‘অগ্নি দেবীশক্তির মুখ’। তাই আগে ঘরে যে প্রদীপ জ্বলত, তা ছিল কালীকে ডাকার এক আধ্যাত্মিক ডাক। শাস্ত্রে বলা আছে, মা কালী থাকেন দিকদিগন্তের অন্ধকারে, তাই আলো দিয়ে তাঁর পথ তৈরি করা হয়। অনেক তান্ত্রিক সাধক প্রদীপের শিখায় ধ্যান করতেন, এবং শিখাকে দেবীর জিভ, কেশ, বা চক্ষুর প্রতীক মানতেন। প্রদীপ জ্বালানো মানে পূজার মঞ্চে শক্তির আগমন ঘটানো।

 

সরষের তেলের প্রদীপ ও গ্রামীণ ঐতিহ্য

বাংলায় ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে সরষের তেলের যোগ সবচেয়ে গভীর। বিশ্বাস ছিল, সরষে তেল অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে দেয়। গ্রামে গৃহবধূরা সন্ধ্যায় উঠোনে, গোয়ালের পাশে, বারান্দায় এবং বট বা নিমগাছের নিচে প্রদীপ জ্বালাতেন, যাতে মা কালী অশুভ শক্তিকে বিনাশ করেন। অনেক পরিবার আজও অঘোরী তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে কালীকে সন্তুষ্ট করার রীতি বজায় রেখেছে।

 

পূর্বপুরুষের আত্মা ও ভূতচতুর্দশীর সংযোগ

কালীপুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশী। এই রাতে ১৪টি প্রদীপ জ্বালিয়ে পূর্বপুরুষের আত্মাকে শান্ত ও সন্তুষ্ট করার এক আদি প্রথা প্রচলিত। ধারণা ছিল, অমাবস্যার অন্ধকারে পিতৃপুরুষেরা ভাসতে থাকেন এবং আলো দেখে তারা পথ খুঁজে পান। তাই বারান্দা, সিঁড়ি, চাতাল, উঠোনে প্রদীপ রেখে পূর্বপুরুষকে আহ্বান ও আশীর্বাদ চাওয়া হত। এই বিশ্বাস থেকেই পরের দিনে কালী আরাধনার প্রদীপের সংস্কৃতি আরও গভীর হয়।

 

দরজা, জানালা ও ছাদে আলো: দেবীর পথপ্রদর্শন

গ্রামবাংলার বহু অঞ্চলে বিশ্বাস ছিল, দেবী কালরাত্রিতে আকাশপথে চলেন। তাই ছাদে, গাছের মাথায় বা বাঁশের উপর প্রদীপ বেঁধে আলো তুলে ধরা হত। একে বলা হত “আকাশবাতি” বা “দীপালোক”। আবার বাড়ির দিকনির্দেশে প্রদীপ রাখাকে ধরা হত কালী ও লক্ষ্মী দুই দেবীর পথপ্রদর্শন হিসেবে। কারণ এই রাতেই কিছু অঞ্চলে দুয়োকেই একসঙ্গে আহ্বান করা হয়।

 

অশরীরী শক্তি প্রতিরোধে প্রদীপের ভূমিকা

লোকবিশ্বাস ছিল, অমাবস্যায় ‘দুষ্ট আত্মা, শাকচুন্নি, ডাইনিবেগুনির’ আসর বেশি থাকে। প্রদীপের আগুনে আগুনদেবতা অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে নষ্ট করেন—এই ধারণা থেকেই ঘরের চারকোণে, পুকুরঘাটে ও উঠোনে প্রদীপ রাখা হত। আগুন মানে জীবন, আলোক, রক্ষা ও শক্তির উপস্থিতি।

 

কালীপুজোর প্রদীপজ্বালানো কোনো সাজসজ্জার অংশ নয়—এটি প্রাচীন আচার, তান্ত্রিক আহ্বান, পূর্বপুরুষ স্মৃতি, অশুভনাশ ও দেবীর শক্তির আলোক প্রতিষ্ঠা। ঘরে ঘরে প্রদীপ মানে একদিকে দেবীকে স্বাগত, অন্যদিকে নিজস্ব ভয়, অন্ধকার, মৃত্যুচিন্তা ও দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
আজ আলোর ঝলকানিতে অনেকেই এর মূল তাৎপর্য ভুলে গেছেন, কিন্তু বাংলার প্রদীপসন্ধ্যা এখনো বহন করে এক গভীর আত্মিক ইতিহাস—যেখানে প্রতিটি শিখা হল শক্তির চোখ, রক্ষার বলয় এবং আলোকের শপথ।

Featured Posts

সখারাম গণেশ পণ্ডিত: এক ভারতীয় যিনি আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ইতিহাস লিখেছিলেন

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যখন আমাদের দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন এক ভারতীয় যুবক হাজার মাইল দূরে আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের...

Popular Posts